শৈশব স্মৃতি

।। পুজোর সানাই।।

'সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে
রোদ উঠেছে ঝিল‍্‌মিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে,
ছুটির দিনে কেমন সুরে
পুজোর সানাই বাজায় দূরে,
তিনটে শালিখ ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে।'

“স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কি বাদ দেয় কত কি রাখে। কত বড়কে ছোট করে, ছোটকে বড় করিয়া তোলে। সে আগের জিনিষকে পাছে ও পাছের জিনিষকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।”

-- (জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

শৈশব, সে কবেকার কথা? পিছন পানে চাইলে মনে হয় সে না জানি, কত কত প্রাচীন কালের কথা, অথচ হাতের কর গুনলে আশ্চর্য হয়ে দেখতে হয়, প্রাচীন কই! সে মাত্র সাড়ে তিন দশক আগের কথা। দশ লক্ষ বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে সে নিতান্ত এক তুচ্ছ, শূন্য-প্রায় ভগ্নাংশ সময় কাল। সে সময় এসেছিল, কখন, বোঝার আগেই, সে হারিয়ে গিয়েছে চোখের নিমেষে। সে সময়ের পুনরাবৃত্তি আর হবে না, আর কোনো দিনও নয়, অথচ, মানুষ আসলে বাঁচে তার ওই ফেলে আসা, হারিয়ে যাওয়া ওই সময়েই!

সময়, সে চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু জীবন পথে তার আসা-যাওয়ার ছাপ রয়ে গেছে। স্মৃতি রয়ে গেছে। কবিঠাকুর যেমন বলেছেন, তেমনিই স্মৃতি সে সময়কে আর হুবহু তুলে ধরতে পারে না। সে ছবি আঁকে; কত অকিঞ্চিৎকর মুহূর্ত কে সে বারবার তুলে ধরে, কত গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তকে অনায়াসে সে মুছে ফেলে! জোড়াতালি দেওয়া এই স্মৃতিচিত্রে পুজো ধরা দেয় কেবল প্রসন্ন এক ছবি হয়ে; পুজো ধরা দেয় আশ্বিনের তেরছা রোদ হয়ে, ভোরের শিরশিরে মৃদু হাওয়া হয়ে, মাঝ-দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে হঠাৎ গা-শিউরে ওঠার মধ্যে দিয়ে!



ছোটোবেলায় যখন ক্যালেন্ডারের হিসেব শিখিনি, যখন ঘড়ির দু-হাত অহর্নিশ তাড়া করে ফিরত না, তখন পুজোর ছুটির জন্যে আলাদা করে অপেক্ষাও করতে হত না। সমস্ত দিনটাই যেন ছিল ছুটি-ছুটি খেলা! বর্ষায় একসময় মাঠ-ঘাট ডুবেছিল, তারপরে সে জল নামতে নামতেই কখন যেন খেয়াল হয়, রোদের দিক গেছে বদলে। বর্ষায়, উঠোনে ভাসিয়ে দেওয়া কাগজের নৌকারা যখন নিশ্চিতভাবে তেপান্তরে পাড়ি জমিয়েছে, তখন ঘরের কোণে ছায়ারা হয়ে এসেছে শীতল, মন-খারাপের মত ভারী; কবে কখন অজান্তে ভোরের ঘুমন্ত শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে, ওমের খোঁজে ঘেষে গেছি মায়ের পেটের কাছে, সে খবর কে রেখেছে; বাইরে কবে ভোরের শিউলির নরম বোঁটার রঙ গাঢ় হয়ে এসেছে, কবে ঘাসের বুকে প্রথম দেখা দিয়েছে শিশিরকণা, এর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ কি আর পাঁজি-পুঁথিতে লেখা ছিল কোনোদিন!



না, ছিল না। স্মৃতি শুধু জানে পুজো আসে, এই ভাবেই, আলো হাওয়ার বদলের মধ্যে দিয়ে। আমাদের মফস্বলে মাঠ ঘাট শুকিয়ে ওঠে, সবুজ মাঠ দিয়ে আবার দৌড়ে বেড়াবার অবাধ স্বাধীনতা মেলে শৈশবের। সমস্ত চরাচর জুড়ে, মাঠ-ঘাট জুড়ে, থোকা-থোকা কাশের দোলায় পুজোর সানাই বাজে অশ্রুত সুরে। কবে যেন স্কুলে পরীক্ষা শেষ হয়, তারপর কবে যেন নতুন জামা কাপড় আসে। সাদা কাডবোর্ড বাক্সে, স্বচ্ছ প্লাস্টিকে মোড়া রঙিন সব জামা-কাপড়;  জামা-শাড়ির ভেতর অমূল্য অস্বচ্ছ ফিনফিনে টিস্যু পেপার ভরা, জুতোর সাথে পাওয়া যায় দু'খানা হলুদ টিপ-কলম আর চাবির রিঙ। কতগুলি জামা হল, সে তুচ্ছ প্রশ্ন ওঠেইনি কোনোদিন। রাজপুত্রের একটাই বেশ। যে দেখে সেই বলে, আহা! কি সুন্দর! বেশ বেশ বেশ!



পুজো এসে পড়ে, বাতাসে ধূপের গন্ধ ভাসে, কর্ণকুহরে অনুরণিত হয় দূরাগত ঢাকের সুর। পুজোর মন্ডপ সেই ওই বড় রাস্তায়, ফ্লাড লাইটের তীব্র সফেন আলোয় রঙিন মানুষজন ভিড় করে আসে তার দোরে। হাঁ করে তার শিশুচোখ দেখে অত্যুজ্জ্বল ঝাড়ের আলো, অবাক হয়ে সে দেখে ইয়া ব্বড় সিংহ, থাবা উচিয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ভীত চকিত হয়ে সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতে চায় রাক্ষসের মত অসুরের নজর থেকে, আর অজান্তেই সে আঁকড়ে ধরে বাবার হাত! ঠাকুর মশাই মঞ্চে ধুনুচি নিয়ে এঁকেবেকে নাচেন, ঢাকীর দল লাফিয়ে ঝাপিয়ে কসরত করে বাজনায় মাতিয়ে তোলে মন্ডপ প্রাঙ্গন। সে ভাবে এত ফল-প্রসাদ-মিষ্টি কে পাবে? বিশেষ করে ওই সাদা সাদা কদমাগুলি, রঙিন শিঙার টুকরোগুলি! সে ভাবে দুগগা ঠাকুরের গলার ওই অত বড় মালাটি কে গাঁথল?  ঢাকীর ঢাকের ওই চামর কি দিয়ে বানায়? ঢাকের বাজনার মাতনে তার ইচ্ছে হয় উথালপাতাল নাচতে, কিন্তু বাবা তাকে যেতে দেয় না সারি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা মানুষের ভিড়ে। ঢাকের শব্দের মাঝে, তার ভাবনার মাঝে, আঘাত আসে মাইকের ঘোষনায়, একটি বাচ্চা ছেলে, হলুদ জামা পরনে, হারিয়ে গেছে সে, কেউ দেখতে পেলে যেন অবিলম্বে তিনি সে খবর জানান দেন মন্ডপের উদ্যোক্তাদের। ঘোষনা শুনে সে বাবার কোল ঘেষে দাঁড়ায়, হাত চেপে ধরে শক্ত করে বাবার কড়ে আঙুল। নিজের দিকে চেয়ে দেখে তার জামা হলুদ কিনা?



ইতিমধ্যেই তিনখানা পুজো দেখা হয়ে গেছে তার এই সন্ধ্যেয়, পা এখন তার ব্যাথাতুর। নতুন জুতোকে শত্রু মনে হয় তার, ভাবে, সবাই কেন খালি পায়ে হাটে না? গলা শুকিয়ে ওঠে তার, ঘুম ঘুম পায়। পা টেনে টেনে হাটে সে, পিছিয়ে পড়তে চায়, বসে পড়তে চায় বটগাছের বেদীতে। বাবা অপ্রসন্ন মুখে তাকে কোলে তোলে, মা দুষ্টু হাসি হেসে তাকায় বাবার বিরক্ত মুখের দিকে। বাবা তাকে আর দাদাকে ফ্রুটি কিনে দেয়, পাইপওয়ালা ফ্রুটি, ঠান্ডা কনকনে; অকস্মাৎ চুমুক মারলে তার দুধের দাঁত কনকন করে, জিভ অসাড় হয়ে যায় ক্ষণকালের জন্যে। দাদা, দেখো, দিব্যি কেমন চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। দাদাকে একটা কথা বলতে হত কানে-কানে। কিন্তু তার আগেই, ইস! দাদা দেখো একটানে পাইপটাকে ফেলে দিল ফ্রুটি খেয়ে! দাদাটা এত্ত বোকা না! পাইপটাকে বাড়ি নিয়ে গেলে, ওরাও, ওই দক্ষিণের বাড়ির ওই বাচ্চাটার মত মুসম্বির রস খেতে পারত দেখিয়ে দেখিয়ে। আচ্ছা, মুসম্বি নাই বা জুটল, গরমের দুপুরে ঠান্ডা জলই খেত না হয়! এসব ভাবতে ভাবতে সে হঠাৎ দেখে কখন তার ফ্রুটজুস গেছে ফুরিয়ে, খালি দোমড়ানো টেট্রাপ্যাকে শুধু শুরুর শুরুর করে বাঁশি বাজছে শূন্যতার।



বাবা বলে, কি হল এইটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে! এই বললে এত্ত ঠাকুর দেখব, আর পথে বেরিয়েই…  তার কেবল ঘুম ঘুম পায়, বাবার কোলখানি তার নাগরদোলা মনে হয়। বাবা রাস্তার মোড়ে এসে এগরোলের অর্ডার দেয়। এটা সত্যি যে এগরোলের জন্যে তার বায়না ছিল বহুদিনের। কিন্তু এগরোল তো শুধু পুজোর সময়েই খাওয়া নিয়ম, তাই ধৈর্য ধরে সে অপেক্ষা করেছে এতদিন। কিন্তু এখন এই ডিম ভাজার গন্ধ, বিট নুনের ঘ্রাণ তার ক্লান্ত শরীরে আর তেমন সাড়া জাগায় না তেমন। কাগজের পোষাক ছাড়িয়ে, নগ্ন রোল তার মুখে ধরলে লাল সস লেগে যায় তার নাকে, ঠোঁটে। মা, মুখ ফিরিয়ে চায়, আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। মায়ের মুখে অদ্ভুত হাসি, ভিড়ের মধ্যে বাবার গা ঘেষে হাঁটতে চায় আদুরে তার মা। ফ্লাড লাইটের বন্যা পেরোলে আবার তারা ফুটে ওঠে আকাশে। ভিড়ের ওম ফিকে হয়ে গেলে শিরশিরে হাওয়া এলোমেলো করে দেয় তার পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল।



রাত নামতে থাকে ঘন ছায়া হয়ে।  বড় পুজোর পাশে, এ রাস্তায় সে মোড়ে ও গলিতে ছোটো মন্ডপে পুজোর ডালি সাজিয়ে আকাঙ্ক্ষিত মুখে বসে থাকে অজানা কলোনীর অচেনা  লোক। কেউ কেউ আসে, অধিকাংশ এড়িয়ে যায় ম্যাটম্যাটে ওই সাদামাটা পুজো। সেই সব লোকেরা নিজেরাই গুজগুজ করে গল্প করে, মাঝে মাঝে মুখ তুলে চায় বড় রাস্তার ঘন জনস্রোতকে। বড় পুজোর উদ্যোক্তারা রাস্তার ধারে ধারে আলোকসজ্জা সাজিয়েছে। ডানা নাড়া ঈগল পাখি, পর্বত কাঁধে বীর হনুমান, মাছের চোখে তীর ছুড়ছেন অর্জুন, বাঁকা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চার্লি চ্যাপলিন, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তার পাশে, দেওয়ালের কোটরে কারেন্টের মোটর ঘুরছে, চিড়িক চিড়িক করে বেগুনী স্পার্ক হয় তাতে। নারীপুরুষ দল বেধে যাচ্ছে, যুবক যুবতীরা, কিশোর-কিশোরীরা। হাসছে, চেঁচাচ্ছে, ঠেলাঠেলি করছে, হাত ধরাধরি করে জোড়ে-বেজোড়ে চলছে তারা, মুখে তাদের পাতার বাঁশি, হাতে ঝুনঝুনে কাঠি বেধাঁনো বেলুন। রঙিন আলোয়, ফুলেলা সুবাসে, রাত গভীর হচ্ছে অল্প অল্প করে, আকাশে সরে সরে যাচ্ছে ক্ষীনকায়া এক-ফালি নবমী চাঁদ।



এরপর কখন তারা বাড়ি ফেরে, কখন সে খায়, কখন তার মা আয়রন করা শাড়ি ছেড়ে আবার পরে নেয় ঘরের সুতো তোলা  আটপৌরে শাড়ি, এসবের আর সে হিসেব রাখতে পারে না। সারা রাত সে স্বপ্ন দেখে, দুগগা ঠাকুরের মুখটা যেন ঠিক তার মায়ের মুখের মত, আর মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে একটা অসুর। কিন্তু মা তার ভয় তো পায়ই না, বরং অদ্ভুত হাসি তার মুখে, হাতে বরাভয়। বাবা কেবল দাঁড়িয়ে থাকে দূরে, অসহায় অপ্রস্তুত মুখে। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে চোখ খুললে সে আঁধো-অন্ধকারে ঠাহর করে, তার একদিকে, খাটের ঘেরা দিকে কাঁথা গায়ে দিয়ে দাদা শুয়ে, আর তার অন্যদিকে বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। মাঝরাতে তাদের টালির ঘরের চালে হিম ঝরে টুপটাপ করে; বাড়ির উত্তর পাশের কুল-বাবলা-কাঁঠালের  জমিতে সরসর করে শব্দ হয়, ছুঁচো আশ্রয় খোঁজে রাতপেঁচার নখর থেকে; কুবকুব করে ডেকে ওঠে পূবের জলাভূমির রাতচরা কোনো পাখি। পরম নিশ্চিন্ত হয়ে, অপার নির্ভরতায়, সে আবার ডুব দেয় ঘুমের অতল স্বপ্ন-সমুদ্রে।

Comments